সময়কালের ক্যাঁচক্যাঁচানি (!)

কিছুদিন ধরেই সময় পরিভ্রমন, আপেক্ষিক তত্ত্ব এসব নিয়ে লিখার বেশ ইচ্ছা করছিলো। কোন সমীকরন না ব্যবহার করে, চাঁপার জ়োরে এগুলো নিয়ে বকবক করা যে কতটা কষ্টকর, সেটা লিখতে গিয়ে টের পেলাম।
যাইহোক আপনাদের একটা প্রশ্ন করি, ধরুন আজকে আপনার জন্মদিন, ঠিক একবছর পর আপনার বয়স কয়দিন বাড়বে? সাধারন কথায় উত্তরটি খুবই সাদামাটা- 'একবছর'। এভাবে চিন্তা করলে শুধু আপনি কেন, একবছর পর আপনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, চেনা-অচেনা সবার বয়সই ঐ একবছরই বেড়ে যাবার কথা।



কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আইনস্টাইন এই সাধারন ধারণাটিকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়ে গেছেন। আইন্সস্টাইন হিসাব-কিতাব করে দেখিয়ে গেছেন সময়ের মাপ পর্যবেক্ষক ও যা পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে তাদের আপেক্ষিক গতি দ্বারা প্রভাবিত। এবং গতিশীল অবস্থায় থাকা ঘড়ি (the clock is moving) , স্থির ঘড়ি (clock is at rest) অপেক্ষা ধীরে চলবে।


সহজ বাংলায় যিনি বেশি ছোটাছুটি করবেন তার বয়স অল্প একটু হলেও কম (!) বাড়বে। । বিষয়টা এতো সহজে চোখে পড়বে না। কারন আমরা যেটুকু ছোটাছুটি করি তার বেগ খুবই কম। এ জিনিসটি চোখের সামনে নিয়ে আসতে হলে কাউকে আলোর বেগের কাছাকাছি গতিবেগে ছোটাছুটি করতে হবে (যদিও মানুষের পক্ষে এইমূহুর্তে সম্ভব না)।


এখন যদি একজন মহাকাশচারী (যার বয়স ২৮ বছর), একটা আধুনিক রকেটে চড়ে (ধরে নিলাম, রকেটের গতি আলোর বেগের কাছাকাছি ) মহাশূন্য ভ্রমনে বের হলেন।
এরপর পৃথিবীতে ৫০ বছর কেটে গেলো। ৫০ বছর পর মহাশূন্যচারী পৃথিবীতে ফিরে আসলেন। বলুনতো মহাশূন্যচারীর বয়স কত হবে? সাধারনভাবে তার বয়স হওয়া উচিত ছিল- ২৮+৫০= ৭৮ বছর। কিন্তু না, আইন্সস্টাইনের আপেক্ষিকতা বলে ঐ মহাকাশচারীর বয়স কখনই ৭৮ বছর হবেনা, তার বয়স হবে ৫৮ বছর। তিনি যে বেগে মহাকাশে ভ্রমন করেছেন তাতে পৃথিবীতে ৫০ বছর কেটে গেলেও মহাকাশযানের ভেতর সময়ের পরিবর্তন হবে মাত্র ৩০ বছর।



বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন নাহয় আমরাই এবার হিসাব কষে দেখি, এটা কতটুকু সম্ভব।
আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার কথা মনে আছে? ওখান থেকেই আমরা শুরু করবো। আপেক্ষিকতার কাল সংকোচনের সূত্র থেকে আমরা জানি-



যেখানে হচ্ছে স্থির ঘড়ির সময়, আর হচ্ছে গতিশীল ঘড়ির সময়।
সুতরাং আমাদের সমীকরনটি দাঁড়ায়-




অর্থাৎ পৃথিবীর ৫০ বছরে (আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে) গতিশীল রকেটের মধ্যে সময় কেটেছে ৩০ বছর। তাহলে মহাকাশচারীর বয়স আসলে বেড়েছে ২৮(তার আগের বয়স)+৩০(রকেটে থাকাকালীন বয়স)=৫৮ বছর। অর্থাৎ তার বয়স ২০ বছর কম বেড়েছে। দেঁতো হাসি
তাহলে সময় পরিভ্রমন কি সম্ভব? হ্যাঁ, ঠিক এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে খুব সহজেই নিজের বয়সকে আটকে রেখে কিছুটা ভবিষ্যতে পাড়ি জমানো সম্ভব (তাত্ত্বিকভাবে)। এটি কিন্তু কোন সায়েন্সফিকশন নয়, এটি থিওরী অফ রিলেটিভিটির ভবিষ্যৎবানী । কিন্তু অতীতে পাড়ি জমানো সম্ভব? টাইমমেশিন তৈরি করা সম্ভব?? হ্যাঁ তত্ত্ব বলে এটা সম্ভব। ওয়ার্মহোল তৈরি করা মাধ্যমে সম্ভব।
সায়েন্সফিকশন গল্পে/ছবির দৌলতে আপনাদের অনেকেই ওয়ার্মহোল সম্পর্কে জানেন। ওয়ার্মহোল হচ্ছে মহাবিশ্বের দুটি ভিন্নজায়গা সংযুক্তকারী একটি শর্টকাট। যেমন, পৃথিবী থেকে কেউ প্লুটোতে যেতে হলে কাউকে কমপক্ষে 4.2 বিলিয়ন কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে (যখন প্লুটো, পৃথিবী আর সূর্য একলাইনে থাকে সেসময়ের দূরত্ব ধরা হয়েছে)।





ওয়ার্মহোলের দুটি মুখ থাকে। ধরাযাক ওয়ার্মহোলের একটি মুখ পৃথিবীতে আরেকটি মাথা প্লুটোতে রয়েছে। এখন কেউ যদি ওয়ার্মহোল ব্যবহার করে তাহলে হয়তো ওয়ার্মহোলের মধ্যে দিয়ে মাত্র ১০০ মিটার হেটে গেলেই প্লুটোতে পৌছে যেতে পারবে। (এরকম জিনিস বাংলাদেশের রাস্তায় এখন খুবই দরকার মন খারাপ )।





হিসাব কিতাব না দেখিয়ে বকবক করে যাচ্ছি দেখে ভাববেননা চাপা ছাড়ছি , Michael S. Morris, Kip Thorne এর মতন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে পেপার লিখে গেছেন, হুঁ হুঁ।


তাদের মতে -"if the laws of physics permit an advanced civilization to create and maintain a wormhole in space for interstellar travel, then that wormhole can be converted into a time machine with which causality might be violatable"। সহজভাবে বলতে গেলে, দুটি সময়ের মধ্যেও এভাবে ওয়ার্মহোল তৈরি করে সময় পাড়ি দেয়া সম্ভব।
কিভাবে?? চিন্তিত মনে করুন একটি বিশাল পেটমোটা ডিকশনারীতে ৫০০০ পৃষ্ঠা আছে। এর ২০১১ নম্বর পাতার উপর একটা উইপোকা ঘুরাঘুরি করছে। সাধারনভাবে তাকে পরের পাতায় যেতে হলে এই পৃষ্ঠাটি খেয়ে ফেলতে হবে (ধরলাম পোকাটি আসলে ভদ্র, হাপুস-গুপুস করে খায়না খাইছে )। এভাবে মহাবিশ্ব আমাদেরকে সময়ের একটি পৃষ্ঠা শেষ করার পর পরের পৃষ্ঠায় যাবার সুযোগ করে দেয়।
এখন ধরুন ঐ উইপোকাটি ২০১১ নম্বর পৃষ্ঠার মাঝামাঝি ফুটো করে খাওয়া শুরু করলো, এবং লম্ব বরাবর খেতে খেতে বইয়ের পাতাগুলি মধ্যদিয়ে একটি লম্বা ছিদ্র করে ফেললো, তাহলে কি হবে?সে হয়তো মুখতুলে চেয়ে দেখবে (আমাদের উইপোকাটি পড়ালেখাও জানে দেঁতো হাসি ) সে বইয়ের ৩০০০ তম পৃষ্ঠায় চলে এসেছে। এভাবে দুটি সময়ের মধ্যে ওয়ার্মহোল এর মাধ্যমে ছিদ্র করে একজায়গা থেকে আরেকজায়গায় যাওয়া সম্ভব।


এইমূহুর্তে হয়তো এটি কল্পকাহিনীর মতো শুনাচ্ছে। কিন্তু একদিন সত্যিই হয়তো মানুষ একসময় থেকে আরেকসময়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। দেঁতো হাসি


সচলায়তনে প্রকাশিত

পাদটীকা